যন্ত্র যখন বন্ধু ছিল

ছোটবেলায় মনে আছে অকেজো যন্ত্র খুলে ফেলার অভ্যাস ছিল আমার। বড় হয়ে বুঝলাম আমার মতো অনেকেরই ওই ঝোঁক ছিল আর এই অনেকের মধ্যে আবার এরকম অনেকেও ছিল যারা খুলে ছড়িয়ে ফেলা যন্ত্রাংশগুলিকে আবার জোড়া লাগাতেও পারত। আমি অত কাজের ছিলাম না, কিন্তু যন্ত্রের প্রতি মুগ্ধতা ছিল। মা আমাদের নিয়ে দাদুবাড়ি গেলে ফিরে এসে দেখতাম বাবা কিছু একটা কিনে রেখেছে, মায়ের জন্য বা আমাদের জন্য। একবার ফিরে এসে দেখি ঢং ঢং ঘণ্টা বাজানো একটা দেওয়ালঘড়ি কিনে এনেছে। প্রত্যেক ঘণ্টায় সেটায় আওয়াজ হয়। প্রথমে আনন্দ হলেও পরে খানিক ঘ্যান ঘ্যান করেছিলাম বলে মনে পরে। আশেপাশে অথবা বন্ধুদের কারো না থাকলেও সিনেমা দেখার দৌলতে আমি ততদিনে কুকু-ক্লক চিনে গেছি। আমার ওটা চাই। পাইনি অথবা কিনে দেওয়া হয়নি, দুটোর কোনো একটা হবে। অনেক ছোট বয়েস থেকেই জানি জিনিসের দাম হয় তাই অপচয় করতে নেই। তাই একটা ঘড়ি থাকলে তো আরেকটা কখনোই কিনতে নেই। কিন্তু শিশুমন তো আর টাকার অর্থ বোঝে না। কতই বা দাম হত?

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আমার পরের যন্ত্র ছিল একটা ক্যাসেট প্লেয়ার, প্যানাসনিকের। তার আগে অবশ্য একটা সোনি’র ওয়াকম্যানও ছিল কিন্তু আমি নিজে তখন এত ছোট যে খুব বেশি গান শুনেছি বলে মনে পরে না। যাই হোক, বাড়িতে ততদিনে কালার টিভি আর ভিসিপিও এসে গ্যাছে কিন্তু ওগুলো শুধুই আমার না, সবার। ক্যাসেট প্লেয়ারটা আমার হল। আমার একদম যখন গ্যাদা বয়েস তখন মায়ের একটা ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল বটে কিন্তু পাকেচক্রে সেটা হাতছাড়া হয়ে যায়। গান শুনতে পারিনা বলে মন খারাপ করায় ক্লাস ফোর কী ফাইভ হবে, বাবা কিনে এনে দিল। এবারেরটা আগের থেকেও ভালো। মায়েরটা ছোটো এবং লাল রঙের ছিল যতদূর মনে পড়ে কিন্তু আমারটা হল কালো – অর্থাৎ আমারটা বেশি কুল। গাবদা মতো একটা যন্ত্র এবং পাশাপাশি দুটো স্লট থাকায় একটার থেকে আরেকটায় রেকর্ডও করা যায়। তার অনেকগুলো নব ছিল, গ্রাফিক ইকুইলাইজার ছিল এবং দু’পাশে বড় বড় দু’টো স্পিকার। অর্থাৎ আমার যন্ত্রটি দিয়ে জোরে জোরে গান শোনা যায়, বাবা যে ক্যাসেট কিনে দেবে না বন্ধুর থেকে জোগাড় করে সেই ক্যাসেট নিজে নিজেই মায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেটের ওপর রেকর্ড করা যায়, আর স্বপ্নে রীতিমত মিসাইল লঞ্চ করা যায়, হেব্বি কুল।

HTB1_vyvNXXXXXXPapXXq6xXFXXXk
প্রায় এরকমই তো দেখতে ছিল, কিন্তু রিমোট ছিল বলে মনে পরেনা।


এর পরে যে যন্ত্রটি এল সেটার প্রতি লোভ খুব সম্ভবত ক্লাস টু বা থ্রি তে ছিল কিন্তু পেলাম ক্লাস সেভেনে বা এইটে। একটা ঘড়ি দেওয়া স্কুলব্যাগ। একটা মস্ত ঘড়ি ক্যাটক্যাটে নীল রঙের ক্যানভাসের ব্যাগের ওপর বসানো। কিন্তু তখন মা-বাবা ছোট ভাবলেও আমি তো বড় হয়ে গেছি। কিছুদিন স্কুলে নিয়ে গেলাম, তারপর এক সময় ঘড়িটা খুলে ঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিলাম।

ce2446581b67bfc7697c9714f5e8618e
ভাবুন…ক্লাস এইটে কেউ এই ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায়???


কিন্তু যেটা বাকি থেকে গেছে সেটা হচ্ছে ক্যামেরা। ওটা আমার নিজের ছিলনা। বাবার ছিল। রুপালী রঙের ক্যামেরা যেটা শুধু স্কুলের অ্যানুয়াল ক্লাস পার্টি এবং পরে সরস্বতী পূজার সময় আমায় দেওয়া হত। তবে ডিল ছিল সব ছবিতে আমায় থাকতে হবে এবং যেহেতু একটা গোটা রোল কিনে দেওয়া হয়েছে তাই অন্তত খান পঁচিশেক ভালো ছবি চাই। এই ক্যামেরায় ছবি তুলেছি ক্লাস টুয়েলভ অব্দি। কী প্রচণ্ড টেনশন হত, সব ছবিতে আমি আছি তো? এমন কোনো ছবি উঠে যাবে না তো যেটা নিয়ে পরে অশান্তি হবে? একটা ছবি উঠে যাওয়া মানে যে প্রায় বিয়ে হয়ে যাওয়া সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। তাই কায়দা করে অনেক বন্ধুর সাথে তাকে পাশে নিয়ে বা না নিয়ে ছবি তুলে রাখতে হবে। বাপরে বাপ্‌…ওই টেনশনের চেয়ে বিয়ে করে নেওয়া ভালো।

A4A8263
বাবার ক্যামেরাটা একদম এরকম কিন্তু EZ Mate বলে কোনো মডেল কিনা বলতে পারব না।

কলেজে পড়াকালীন আমাদের বাড়িতে সিডি প্লেয়ার এল। ঘটনাচক্রে কালার টিভি দু’বার পালটানো হয়েছে কারণ পুরনো টিভিতে ১০০টা চ্যানেল দিত না। দ্বিতীয় টিভিটা খুব সম্ভবত আমাদের কেনাও নয়। এখনও ওটা চলছে। মা ফ্রিজ পাল্টেছে দু’বার, চল্লিশ বছরের কাছাকাছি সংসার করছে। আমার মায়ের শাড়ির আলমারি একটা, একটা ফ্যান একেবারে অকেজো হয়ে যাওয়ায় প্রায় ১৬-১৭ বছর পর নতুন ফ্যান কিনেছে। একটা ড্রেসিং টেবিল যেটার বয়েস প্রায় কুড়ি বছর, সোফারও তাই। দেখে বোঝার উপায় নেই কারণ যত্নের ছাপ এতটাই প্রকট। নেহাতই আমাদের পরিবারকে দু’বার নতুন করে সংসার শুরু করতে হয়েছে নাহলে আরও কিছু জিনিস কম কেনা হত, আরও কিছু পুরনো জিনিস থাকত।

আজ একজন এসে আমার কাজের ঘরে রাউটারটা আপগ্রেড করে দিয়ে গেলেন। যাবার সময় বললেন আমাদের ফ্যানটা পাল্টাতে নাহলে বিদ্যুৎবিল কমবে না। কথাটা ঠিক। এই ফ্যান অনিন্দ্যদের এবং অতি পুরনো, পালটানো প্রয়োজন হয়ত। কিন্তু পালটাবার উপদেশ দিতে গিয়ে উনি যা বললেন সেটা শুনে কেমন নিজের ভিত নড়ে গেল যেন। বললেন এখনকার নিয়ম হচ্ছে পাঁচবছরের মাথায় সব পাল্টে ফেলতে হবে। ফ্যান, ফ্রিজ, কম্পিউটার সব।

118306678_601827917181896_6761404724856995609_n
আমাদের সাত বছর আগে কেনা ফ্রিজ।
118454862_2417281331908120_2170097059269593757_n
এই ফ্যানের বয়েস জানিনা…


আমাদের পরিবার সেকেলে এবং প্রায় সবক্ষেত্রেই আমার বাবার সাথে বনে না। কিন্তু সে তো অন্য কথা। যতদিন সম্ভব হয়নি, আমার হাজার পিড়াপিড়িতেও কম্পিউটার কিনে দেয় নি। ক্লাস টেনের পরীক্ষার শেষে কম্পিউটার এল এবং সেকেলে নিয়মে রেজাল্ট বেরনোর আগের তিন মাস আমি কম্পিউটার শিখতে গেলাম। আমি জানি ওই সময় কম্পিউটার কেনার পেছনে বাবার নিজের কাজে সেটাকে ব্যবহার করার চাহিদাটাও কাজ করেছে বিশাল কিন্তু ওই কম্পিউটার আমার চলেছে এমএ অব্দি, কিছু কলকব্জা বাড়াতে কমাতে হয়েছে মাঝে এটুকুই। ওই কম্পিউটারের স্পিকার এখনও বাড়িতে আছে। আমি চাকরী পাবার পর পুরনোটা বেঁচে একটা এলসিডি মনিটার দেওয়া কম্পিউটার কিনলাম।

জিনিসের কোয়ালিটি খারাপ হচ্ছে। এখন সত্যিই বছর পাঁচেকের বেশি অন্তত কম্পিউটার চলে না। আমার প্রথম মোবাইল আর দ্বিতীয়টার মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল বছর তিনেকের এবং কারণটা শুধুই ফ্যাশন। টিউশানি করে হাতে টাকা জমেছে। সবাই পালটাচ্ছে তাই আমিও পালটাবো। এখন দু’বছরের বেশি প্রায় টানাই যায় না। কিন্তু এইভাবে যদি সমানে দরকারি যন্ত্র কিনে যেতে হয় তাহলে জীবনে শখের যন্ত্র বলে থাকবে টা কী? ছোটরা শিখবে কী? শখের কেনা আর দরকারি কেনার মধ্যে তফাৎ কী করে করব?

যন্ত্র তো ভালবাসতাম আর সেকারণেই যখন যা কিনতে চেয়েছি সবই প্রায় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে কারণ শখের কেনা আর দরকারের কেনার মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। স্কুলের অনেক বন্ধুদের থাকলেও আমার যান্ত্রিক পেনসিল শার্পনার ছিল না। দু’দিকে চুম্বক দেওয়া পেনসিল বক্স চেয়ে চেয়েও পাইনি কারণ দাম অন্তত ৫০টাকা বেশি ছিল। সবার বাড়িতে সিডি প্লেয়ার চলে এল কিন্তু আমার বাড়িতে প্রায় বছর তিনেক দেরিতে কারণ ক্যাসেটের থেকে সিডি কিনে শোনার খরচ বেশি। এগুলো তো ভালো শিক্ষা বলেই জানতাম। এখন দেখছি জীবনটাই যন্ত্রে ভরে গেছে। শখের জিনিসেই এখন দমবন্ধ লাগে। টাকা জমিয়ে প্রথম ল্যাপটপ কিনি কারণ ওটা আমার শখের ছিল, কাজের না তাই দেরিতে কিনলেও চলে। এখনও আমার নিজের একটা ক্যামেরা নেই। ওদিকে বাবারটা চলেছে যতদিন ফিল্মে তোলা যেত ততদিন। আমি কিনতে ভরসা পাইনা কারণ যাই কিনব আবার পাঁচ বছর পর পালটাতে হবে।

টাকা নাহয় নাই জমালাম তাই বলে দরকারি জিনিসও যদি সমানে আপগ্রেড করতে হয় তখন তো মরার সময়েও জল পাবোনা রে ভাই! দিনের শেষে এত কিছু কিনেও আমার বাপ-মা নিজের সঞ্চিত অর্থে দিব্য বেঁচে আছে। কিন্তু আমাদের এই মুহুর্তে চাকরী জিইয়ে রাখতেই যা খরচা করতে হয়, শেষ বয়েসে মেডিক্লেমের পয়সা দিতে পারব কিনা কে জানে।

যে পরিবারে পাঁচ বছরে ফ্রিজ আর ফ্যান, দশ বছরে খাট আর আলমারি পালটাতে হয় সেই পরিবার স্মৃতি জমায় কীভাবে? আমার বাঙাল প্রাণ, আমি জিনিস ফেলতে পারিনা। কিছু জিনিসে আমি ঠিকঠাক ইনভেস্ট করা পছন্দ করি যাতে ঘনঘন পলাটাতে না হয়। তা সত্তেও আমার ঘরে শুধু দরকারি জিনিসেরই যা জঞ্জাল তৈরি হয়েছে এবারে শখের জিনিসের কথা প্রায় ভুলেই যেতে হবে।

আর যন্ত্র!!! দেওয়ালে রাউটারটা আটকে দিয়ে গেছে, তার চারটে শিং আছে, আর অনেকগুলো আলো তিরতির করে জ্বলছে। এখন আর ইম্যাজিন করতে হবে না, সত্যিকারের ডিস্টোপিয়া চলছে। চারদিকে অদৃশ্য তরঙ্গ মাথার ঘিলু খুটে খুটে খাচ্ছে। সাধের সভ্যতা আর সাধের যন্ত্র সব এখন কালমোহন বেঙ্গলির সুভাষিত বন্দরে দো দো ডলার বিক্রি হচ্ছে। খালি কেনো আর কেনো…সস্তার বারো অবস্থা।

118254427_2756005774720786_3485681921945401070_n
ঘরের দেওয়ালে এখন এটি শোভা পাচ্ছে।

 

 

Leave a comment