ছেঁড়া গদ্য ১

তোমার মনে থাকবে না কারণ তুমি সেখানে ছিলে না। তোমার মনে থাকার কথা না কারণ তুমি ওখানে কোনদিন যাওনি। তোমার মনে থাকার কোন কারণই নেই যেহেতু তুমি ওদেশে জন্মাওনি। আমি ছিলাম। তোমার প্রেম আমায় সেখানে ছুঁতে পারেনি। বড় বড় বাড়ির ছাদের ওপর থেকে যে আকাশ দেখা যায় সেই আকাশে আমি ছিলাম। ছাদের ওপর থেকে নিচে উঁকি দিতে পারতাম না কারণ আমি তখন ছোট মানুষ। কিন্তু যা বুঝতাম তা হলো এই ছাদ থেকে রাস্তা বিশেষ দেখা যায় না। চারপাশে সব বাড়ি। ছোট বাড়ি, বড় বাড়ি, একতলা বাড়ি, পাঁচতলা বাড়ি। আমার বাড়িও পাঁচতলার ওপরে ছিল। একটা ছোট্ট হাঁসছানা আমার ছাদে ছিল। প্রথম যেদিন মা জামার নিচে সেমিজ পরিয়ে দিয়েছিল, আমি ভীষণ কায়দায় ছাদে খেলতে গিয়ে ওপরের জামাটা খুলে ফেলেছিলাম। টেলিভিশনে দেখেছিলাম তার আগে – মহিলা টেনিস প্লেয়ার ওপরের জ্যাকেট খুলে আমার সেমিজের মতোই দেখতে একটা পোশাক পরে খেলতে নামত। আমিও ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম। আর পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেই হাঁসুখোকা।

আমার অত্যাচারের সীমা ছিল না। তুমি তখন আমায় দেখলে ভালবাসতে পারতে না। ভাগ্যিস তোমার কিছু মনে নেই। ওই ছোট্ট হাঁসটাকে কঞ্চি লাঠি দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে তাড়া করতাম সাড়া ছাদ জুড়ে। জানে দম ছিল ওইটুকু পাখির। ভাগ্যিস পাখির মতো উড়তে পারত না। একদিন দুপুরে যখন ওই একই কঞ্চি দিয়ে হাঁসুখোকার প্রাণ জেরবার করছি, পাশের ছাদে এক মাঝবয়েসী মহিলা চোরকে ধরে আশেপাশের সব মানুষ মোটা বাঁশ দিয়ে পেটাচ্ছিল। তুমি দেখোনি সেই দৃশ্য। “আল্লারে আল্লারে…” বলে ওই মহিলার চিৎকার তুমি শোননি। আমি শুনেছি। সব বাড়ির ছাদে তখন অজস্র মানুষ। সবাই মহিলা। প্রত্যেকের ছাদে সদ্য কোরবানি ঈদের মাংস রোদে শোকাচ্ছে তখনও। বাতাসে শুকনো রক্ত আর মাংসের গন্ধ। আমি শিখেছিলাম কোরবানির মাংস কেউ একা খায় না। অনেক ভাগ হয়, সেই ভাগের বেশকিছুটা ওই চোর মহিলাটির মতো মানুষদের মধ্যেও বিলানো হয়। ওই গন্ধ আমার সওয়া ছিল, কিন্তু ওই মাংস মুখে তোলা পাপ। মা বলেছিল। স্কুলে এক বন্ধু না বলে বিরিয়ানি খাইয়ে সারা স্কুলে বলে বেড়িয়েছিল আমার ধর্মভ্রষ্ট হয়েছে। তুমি সেদিন থাকলে হয়ত আমায় লজ্জা থেকে বাঁচাতে পারতে। আমি একথা কাউকে বলিনি।

যে বাড়িতে ওই চোর ঢুকেছিল, সে বাড়ির এক বয়স্কা মহিলা ওইদিন সেই চোরকে বাধ্য করিয়েছিলেন ঝাড়ফুঁকের জল খেতে। ওতে নাকি সত্যি কথা বেড়িয়ে আসবে। কী জানি কী হলো, ওর মাথায় বাঁশের বাড়ি পড়ায়, ওর চিৎকারে, সবার গালাগালিতে যেটা হলো না, ওই জল খাবার দৃশ্যে সেটা হল। আমি ভয় পেলাম। অপমানের ভয়। এখনও বুঝতে পারি না, কীসে বেশি অপমান, মার খাওয়ায় নাকি ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন একটা কিছু করায় যাতে তোমার শরীরের নকশা বদলে যেতে পারে। সেদিন তুমি ছিলে না।

তুমি এখন দেখতে পাও। যখন তোমার দেশে এরকম হয়। তোমার ভয় করে, হতাশা আসে, তুমি সিটিয়ে যাও। আমি ভয় পাই না। ওই যে আকাশের লাল রং, বাতাসে মাংসের গন্ধ, ছাদের ওপর হাঁসুখোকার ছটফটানি এগুলো আমায় তৈরি করে গেছে এই ভবিষ্যতের জন্য। আজ আমি বুঝি, নাকি জানি (?), যে ছাদের আকাশে হাঁসুখোকা উড়ে বেড়ায়, সেই একই ছাদে জলপড়া খাইয়ে চোরের শাস্তি হয়। কিন্তু আমি তো চোর ছিলাম না। খুব বেশি হলে, ছোটবেলায় মিশনারি স্কুলে অনাথ বাচ্চাদের চাঁদা দেবার নাম করে যে টাকা বাড়ি থেকে নিতাম তার সবটা না দিয়ে কিছু নিজের জন্য রেখে দিতাম। তাও সেটা স্কুলের বাইরে ঠেলা নিয়ে বসা চাচার কাছ থেকে শাপলা ফুলের মতো করে কাটা আমড়া খাব বলে। ওই আমড়ায় যে লবণ ছড়িয়ে দিত, তা খেলে তুমি মরেই যেতে। আর খেতাম কালো আমসত্ত। মা বলত ওগুলো পচা আম দিয়ে বানায়। পচাই হবে, নাহলে অত টক আর অত স্বাদ হয়? আমি জানি মা একবার দেখতে পেয়েছিল। জলপড়ার ভয় তখনও আমার যায়নি। ভেবেছিলাম চেপে ধরলে কী বলব? স্বীকার করায় বেশি লজ্জা নাকি জলপড়া খাওয়ায়, আমি ঠাউরে উঠতে পারিনি।

আমার ঘুম ভাঙত দেশের গানে। প্রতি বছর, একই সময়ে। ওই গান শুনে আমি কাঁদিনি কখনো। শুধু ভাবতাম এই গান আমার গান। আমার ঘরের সব জানালা খুলে দিতাম যখন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ওই গান চলত। আমি তখনও জানি না দেশ কী। শুধু জানি এই গান মায়ের গান, এই গান ভালোবাসার গান, এই গান বাঁশির গান। যে বাঁশি শুনে ঘরে মন থাকে না রাধারানীর, এই হলো সেই এলোপাথারি আকুলতার গান। এই গানে পাঁচতলার ফ্ল্যাটবাড়িতে বসে থেকেও অফুরন্ত পদ্মায় সাঁতার কাটা যায়, দোয়েলের কিচিরমিচির শুনতে পাওয়া যায়, চোখ বন্ধ করলেই শাপলা দেখা যায়। এই গানে মাদকতা আছে। কিন্তু তখন তো আমি মাদকতার মানেই বুঝতাম না। আজকের আমি যদি তোমার সাথে আবার আমার ওই ছোট্ট ঘরে এক বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওই গান শুনতাম, আমি জানি, আমার ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে মন চাইত। তোমায় ফেলে রেখে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে মন চাইত। আর যখন সত্যিই চলে গেছি তখন তোমার কথা ভেবে বুকের ভেতর প্রজাপতিগুলো আছাড়িপাথারি করত।

তোমার দেশে আমি আমার গান গাই না আর। আমার গলায় সুর ধরে না। শুধুই কান্না পায়। জোরে জোরে কাঁদতে লজ্জা করে, ভয় করে তাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি। আর এভাবে কাঁদতে কাঁদতে এতো ক্লান্ত লাগে যে নিজের গান ভুলে তোমার গানকে আপন করে নিই। তোমার গান আমার গানের চাইতে শক্তিশালী। আমি সম্ভ্রমের সাথে উঠে দাঁড়াই। তোমার প্রতি, তোমার দেশের প্রতি, তোমার ভালোবাসার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় নতজানু হয়ে থাকি। মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না শুধু তুমি আছ বলেই কী এই গানের এত ক্ষমতা, নাকি এই গান আছে বলে তোমায় ভালোবাসি। আমার গান, তোমার গান, দুটোই তো প্রায় একই গান। আমাদের সংসারে যে আদর আছে, ঝগড়া আছে, আর তার সাথে মনভোলানো সুর আছে তা তো এই দুই গানেরই সুর। আমার বাঁশিতে তো তোমারই জয়ের গাথা লেখা থাকে। তাহলে কেন তুমি আমার গানে আর আমি তোমার গানে এতো আলাদাভাবে সাড়া দিতে বাধ্য হই? আমার গানে তোমায় উঠে দাঁড়াতে হয় না। বুকে হাত রাখতে হয় না। নিজেকে প্রমাণ করতে হয় না। কিন্তু তোমার গানে…?

আমি বাধ্য হই তোমার গান এড়িয়ে যেতে। আমার যখন মন ভালো নেই, আমি তোমার গান শুনি না। তোমার গানে যে অধিকার আছে, দাবী আছে তা আমি না চাইলেও আমাকে বেঁধে রাখে। আমার খোলা মন বেঁধে ফেলতে চায় তোমার গান। কিন্তু আমার গানে তো হারিয়ে যাবার সুর ছিল, ভেসে যাবার লয় ছিল, উড়ে যাবার ছন্দ ছিল। তোমার গান এমন হলো কেন? তবে আমি তোমায় দোষ দিই না। তুমি আমায় বাঁধতে চাওনি। আমি জানি। আমি বুঝি। কিন্তু তুমি আমায় ছাড়তেও চাওনি। তোমার চোখের সামনে কাল যখন আমায় এই গান না গাইবার জন্য জলপড়া খাওয়াবে তুমি কিছু করতে পারবে না। তোমার হাত বাঁধা। কারণ কাল শুধু আমার শাস্তি নয়, তোমারও পরীক্ষা।

আমার ভয় করে। ওই জল একবার খেলে আমি তো আর আমি থাকব না। আমার সব লুকনো সত্যি আমি বলে দেব। আমার এতো না বলা কথা সবাই জানতে পেরে যাবে। যে কথা তোমায়ও বলিনি, কারণ বলতে চাইনি সে কথা। যা বলতে চাই না, সেকথা শুনে যখন তোমার খারাপ লাগবে তখন তুমি আমার চোখে খুঁজবে আশ্বাসের ছোঁয়া। কিন্তু পাবে না। কারণ আমি পাল্টে গেছি। তোমার আমার ঘর বাঁধার গান আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার এতদিনের জমানো রাগ সব ধ্বংস করে দিতে পারে সেদিন। আমি তখন আমারই দেশে আশ্রিতা, আমারই দেশের রিফিউজি। সেইদিন পদ্মার সমস্ত জল শুকিয়ে যাবে, বাতাসে পোড়া মাংসের ছাই তোমার ফুসফুসে আস্তরণ ফেলে দেবে, আর আকাশ থেকে টপটপ করে পড়া ছোট্ট ছোট্ট হাঁসুখোকার মৃতদেহে তোমার ছাদ ভরে যাবে। যে দেশে আমাকে পাঠাতে চাও, সেই দেশের আবর্জনা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে তোমায়। তোমার দায়িত্বে রাখা আমার সন্তানের মুখে তুলে দেবার মতো জল, কানে শোনার গান, আর ঘরের আদর কোনটাই তুমি দিতে পারবে না। কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথার বরফের মতো এক একদিন নতুন করে তখন আমি জন্ম নেব আর তোমার দেশের সূর্য আমায় প্রতিদিন নতুন করে মেরে ফেলবে। তুমি দেখতেও পাবে না।

তোমার আর আমার ভাষা এক। কিন্তু জলপড়া খেলে আমার ভাষা তোমায় জ্বালিয়ে দিতে পারে। মায়ের মুখে সেই ভাষা থাকে না।

Leave a comment